সিয়াম, রামাদ্বান ও কুরআন

সিয়াম, রামাদ্বান ও কুরআন


সিয়াম কি?

সুবহে সাদিক তথা প্রভাত থেকে সূর্যাস্ত (মাগরিব) পর্যন্ত আল্লাহর এবাদত ও সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পানাহার, দাম্পত্য মিলন ইত্যাদি সকল সিয়াম ভঙ্গকারী কর্ম থেকে বিরত থাকা হল সিয়াম। আত্মার পরিশুদ্ধি, আধ্যাত্মিক উন্নতি, মানবিক মমতাবোধের বিকাশ, তাকওয়া ও সততা অর্জনের জন্য সকল যুগের সকল বিশ্বাসী মানুষের অন্যতম প্রধান অবলম্বন হলো সিয়াম। 
রামাদ্বানের সিয়াম প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারীর জন্য ফরয এবং এটি ইসলামের রুকন। এছাড়া যথাসম্ভব বেশি অতিরিক্ত বা নফল সিয়াম পালনে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ফরয ও নফল সিয়ামের ফযীলত অত্যন্ত বেশি। এমর্মে কোরআনে আয়াত অসংখ্য সহীহ্ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। 

সিয়াম ফরয করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন:

يا أيها الذين آمنوا كُتبَ عليكم الصيام كما كُتبَ على الذين من قبلِكم لعلكم لعلكم تتقون

“হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর সিয়াম লিপিবদ্ধ (ফরয) করা হয়েছে, যেরূপভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর তা লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।” (সূরা বাকা : ১৮৩ )

সিয়ামের  ফযিলত

রাসূল (স) ইরশাদ করেন:  
“আদম সন্তানের সকল কর্ম তার জন্য। একমাত্র ব্যতিক্রম হলো সিয়াম, তা শুধু আমরই জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দিব। সিয়াম হলো ঢাল। তোমাদের কেউ যে দিনে সিয়াম পালন করবে সেই দিনে সে অশ্লীল বা বাজে কথা বলবে না ও চিল্লাচিল্লি, হৈচৈ বা ঝগড়াঝাটি করবে না। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তা সাথে মারামারি করে তবে সে যেন বলে, আমি সিয়ামরত, আমি সিয়াম রত। মুহাম্মাদের জীবন যাঁর হাতে তার শপথ, সিয়ামরত ব্যক্তির মুখের ক্ষুধা-জনিত গন্ধ আল্লাহর নিকট মেশকের সুগন্ধির চেয়েও প্রিয়। সিয়াম পালনকারীর জন্য দুইটি আনন্দ রয়েছে- যখন সে আনন্দিত হয়: (১) যখন সে ইফতার করে তখন সে তার ইফতারীর জন্য আনন্দিত হয় এবং (২) যখন সে তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাত করবে তখন সে তার সিয়ামের জন্য আনন্দিত হবে। (সহীহ্ বুখারী ২/৬৭৮, মুসলিম ২/৮০৭)

তিনি আরো বলেন:

الصيامُ جنةٌ مِن النار كجنة أحدِكم من القتالِ وصيامٌ حسنٌ أيامٍ من كلِّ شهرٍ

“যুদ্ধে তোমাদের যেমন ঢাল থাকে, তেমনি জাহান্নামের আগুন থেকে ঢাল হলো সিয়াম। আর প্রতি মাসে তিন দিন সিয়াম পালন করা ভাল। (সহীই ইবনু খুযায়মা ৩/১৯৩)

প্রতি মাসে তিন দিন সিয়াম ছাড়াও যথাসম্ভব বেশি বেশি নফল সিয়াম পালনে উৎসাহ দিয়েছেন রাসূল (স)। কারণ সিয়াম একটি তুলনাবিহীন ইবাদত। আবূ উমামা (রা) বলেন, “আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (স), আমাকে একটি আমল শিখিয়ে দিন। তিনি বলেন, عليك بالصوم فإنه لا عَدلَ له
“তুমি সিয়াম পালন করবে, সিয়ামের মত আমল আর নেই।” আবূ উমামা বলেন, আমি তিনবার তাঁকে একইরূপ অনুরোধ করলাম এবং তিনি তিনবারই একই উত্তর দিলেন। এজন্য আবূ উমামা প্রায় ১২ মাসই সিয়াম পালন করতেন।  (সহীই ইবনু খুযায়মা ৩/১৯৪)

নফল সিয়াম পালনের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো আশুরার দিন, আরাফাতের দিন এবং শাওয়াল মাসের ৬ দিন। এছাড়া প্রতি সপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার এবং আরবী মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ নফল সিয়াম পালন করা বিশেষ গুরুত্বপর্ণ ইবাদত। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, মাসে কয়েক দিন সিয়াম পালন করা দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

সিয়ামে রামাদ্বানের বিশেষ গুরুত্ব ও ফযিলত 

রামাদ্বান মাসের সিয়াম পালন করা ফরয এবং এই সিয়াম পালন ইসলামের ৪র্থ স্তম্ভ। এমর্মে
রাসূল (স) ইরশাদ করেন:  
“রামাদ্বান মাস যখন আগমন করে তখন জান্নাতের দরজাগুলি খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। (সহীহ্ ইবনু খুযাইমা ৩/১৯৪)

তিনি আরো বলেন:
তোমাদের নিকট রামাদ্বান মাস এসেছে। এই মাসটি বরকতময়। আল্লাহ তোমাদের উপর এই মাসের সিয়াম ফরয করেছেন। এই মাসে আসমানের দরজাগুলি খুলে দেওয়া হয় এবং এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই মাসে দুর্বিনীত শয়তানদেরকে শৃঙ্খলিত করা হয়। এই মাসে এমন একটি রাত আছে যা এক হাজার রাত অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি সেই রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত সে একেবারেই বঞ্চিত সে একেবারেই বঞ্চিত হতভাগা। (সহীহুত তারগীব ১/২৪১) 

সিয়াম ও কুরআন

মহান আল্লাহ তাকওয়া অর্জনের জন্য আমাদেরকে দু’টি বিষয় একত্রে দিয়েছেন: সিয়াম ও কুরআন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা সিয়াম নিয়ছি এবং কুরআন বাদ দিয়েছি। এজন্য প্রকৃত ও পরিপূর্ণ তাকওয়া অর্জন করতে পারছি না। 

মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন:
“রামাদ্বান মাস। এতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে তারা যেন এই মাসে সিয়াম পালন করে।” (সূরা বাকারা: ১৮৫) 

অত্র আয়াতে কারীমার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই যে, মহান আল্লাহ কুরআনের সাথে রামাদ্বানের সিয়ামকে জড়িত করে দিয়েছেন। হাদীস থেকে জানা যায় যে, এ সংশ্লিষ্টতা দু’ভাবে। প্রথমত রামাদ্বানে রাত-দিন কুরআন তিলাওয়াত করা এবং দ্বিতীয়ত রাতে তারাবীহের সালাতে কুরআন পড়া বা শুনা।

মুমিনের অন্যতম ইবাদত কুরআন তিলাওয়াত করা। আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ যিকর কুরআন তিলাওয়াত। কুরআন কারীমের একটি আয়াত শিক্ষা করা ১০০ রাক’আত নফল সালাতের চেয়েও উত্তম বলে হাদসে বলা হয়েছে। সারা বৎসরিই তিলাওয়াত করতে হবে। বিশেষত রামাদ্বানে বেশি তিলাওয়াত করা রাসূলুল্লাহ (স)-এর বিশেষ সুন্নাত, যাতে অতিরিক্ত সাওয়াব ও বরকত রয়েছে।

সম্মানিত পাঠক! অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আমাদের মধ্যে উপস্থিত অনেক মুসল্লীিই কুরআন পড়তে পারেন না। যদি দুনিয়ার কোন মন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি আপনাকে একটি চিঠি পাঠান তা পড়তে ও বুঝতে আপনি কত ব্যস্ত হন। আর রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তাঁর হাবীব মুহাম্মাদ (স) এর মাধ্যমে আপনাকে এ কিতাবটি পাঠালেন, আর আপনি একটু পড়ে দেখলেন না। আল্লাহর কাছে গিয়ে কি জবাব দিবেন? যে কিতাব পাঠ করে এখনো হাজার হাজার কাফির মুসলিম হচ্ছে, আপনি মুসলিম হয়ে সে কিতাবটা পড়লেন না। অনেক নও-মুসলিম আছেন যারা মুসলিম হওয়ার পরে ৩/৪ বৎসরের ভিতরে কুরআন তিলাওয়াত ও অর্থ বুঝার যোগ্যতা অর্জন করেন। আর আমরা জন্ম থেকে মুসলমান আমরা অনেকেই পড়তে পারি না। তাহলে ভেবে দেখা দরকার আমরা কত হতভাগা! অথচ রাসূল (স) ইরশাদ করেন, خَيْرُكم مَن تعلم القرآن وعلمه 
“তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি কুরআন শিক্ষা করে ও মিক্ষা দান করে সেই সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।” (সহীহ্ বুখারী ৪/১৯১৯)

রাসূল (স) বলেন: 
“যে ব্যক্তি কুরআনের একটি বর্ণ পাঠ করবে সে একটি পুণ্য বা নেকী অর্জন করবে।  পুণ্য বা নেকী দশগুণ বৃদ্ধি করে প্রদান করা হবে।” (তিরমিযী ৫/১৭৫, সনদ সহীহ)

রাসূল (স) আরো বলেন: 
“যে ব্যক্তি কুরআন ‍তিলাওয়াতে সুপারদর্শী সে সম্মানিত ফিরিশতাগণের সঙ্গী। আর কুরআন তিলাওয়াত করতে যার জিহ্বা জড়িয়ে যায়, ‍উচ্চারণে কষ্ট হয়, কিন্তু কষ্ট করে অপারগতা সত্ত্বেও সে তিলাওয়াত করে তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ পুরস্কার।”  (সহীহ্ বুখারী ৬/২৭৪৩, মুসলিম ১/৫৪৯)
 
সিয়াম  ও কুরআন উভয়ে শুপারিশ করবে
এ মর্মে রাসূল (স) বলেন, “সিয়াম ও কুরআন বান্দার জন্য শাফা‘আত করবে। সিয়াম বলবে: হে রব্ব, আমি একে দিনের বেলায় খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত রেখেছি, কাজেই তার পক্ষে আমার শাফা‘আত কবুল করুন। কুরআন বলবে: হে রব্ব, আমি একে রাতের বেলায় ঘুম থেকে বিরত রেখেছি, কাজেই তার পক্ষে আমার শাফা‘আত কবুল করুন। তখন তাদের উভয়ের শাফা’য়াত কবুল করা হবে। (মুসনাদ আহমদ ২/১৭৪, সনদ সহীহ) 

এক হাদীসে রাসূল (স) বলেন, যারা কুরআনের মানুষ- অর্থাৎ কুরআন পাঠ, হৃদয়ঙ্গম, প্রচার ও পালনে রত- তারািই পৃথিবীতে আল্লাহর পরিজন। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর পরিজন হওয়ার তাওফীক দান করুন। আ-মী-ন।

সালাত ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দু’আ শিখতে এখানে ক্লিক করুন

Thanks for reading. جزاك الله خيرا
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url