নেশা ও জুয়া


জালালুদ্দীন বিন নাজির হোসেন


নেশা ও জুয়া কুরআন ও হাদীসের দৃষ্টিতে অনেক বড় পাপের কর্ম। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ কুরআন মাজিদের সূরা আল মায়িদার ৯০ নং আয়াতে ইরশাদ করেন-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (90) سورة المائدة

“হে ঈমানদারগণ! শরাব, জুয়া, বলীদানের বেদী ও ভাগ্য নির্ণয়ক তীর অপবিত্র, উহা শয়তানের কাজ। এসব হতে বেঁচে থাক। হয়ত তোমরা কল্যাণ লাভ করবে।”

অত্র আয়াতে কারিমায় আল্লাহ তায়ালা মুমীন তথা বিশ্বাসীদেরকে মদ্যপান ও জুয়াবাজী করতে জরালোভাবে নিষেধ করেছেন। প্রত্যেক জুয়াই অবঞ্ছিত, হোক তা শিশুদের বাজীখেলা কিংবা মার্বেল খেলা। পাশা (তাশ) ও ঘুঁটি (লুডু) খেলাও এক ধরনের জুয়া।

ইব্ন আব্বাস (রা) হতে যাহ্হাক (র) বলেন: الْمَيْسِرُ -এর অর্থ হলো জুয়া। ইসলাম আসার পূর্বে জাহিলদের মধ্যে জুয়া খেলার প্রচলন ছিল। আল্লাহ তা‘য়ালা এই নৈতিকতা বিধ্বংসী খেলার উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।

কাসিম ইব্ন মুহাম্মদ (র) বলেন: যে খেলা মানুষকে আল্লাহর স্মরণ এবং নামায হতে বিরত রাখে, তাই জুয়া।

বুরায়দা ইব্ন হাসীব আল-আসলামীর সূত্রে সহীহ্ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন: “যে কাআব (ঘুঁটি দিয়ে) খেলবে, সে শূকরের রক্ত দিয়ে নিজের হাত রঞ্জিত করবে।”

ইমাম আহমদ (র)... মুহাম্মদ ইব্ন কা‘ব হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (স) ইরশাদ করেছেন: কা‘আব খেলার পর সালাত পড়ার লোকের উপমা হল সেই ব্যক্তি, যে অপবিত্র দুর্গন্ধময় শূকরের রক্ত দিয়ে উযূ করে সালাতে দাঁড়ালো।

নেশা ও জুয় সম্পর্কে আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে-

رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ 

“অর্থাৎ, এসব ঘৃণ্য বস্তু ও শয়তানের কাজ।”

শেষে বলা হয়েছে- فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ অর্থাৎ, তোমরা তা বর্জন কর। যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।

মদ হারাম সম্পর্কিত হাদীসসমূহ

হাদীস-১: ইমাম আহমদ (র) ... উমর ইব্ন খাত্তাব (রা) হতে বর্ণনা করেন: প্রথম যখন মদের নিন্দাসূচক আয়াত নাযিল হয়, তখন উমর ইব্ন খাত্তাব (রা) বলেছিলেন, হে আল্লাহ! এই ব্যাপারটি আমাদিগকে স্বচ্ছভাবে ব্যাখ্যাসহ বলে দিন। অত:পর সূরা বাকারায় একটি আয়াতটি নাযিল হয়।  যার অর্থ হলঃ “তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। তুমি তাদেরকে বলে দাও, এতে উপকার অপেক্ষা অপকার বেশি।

অত:পর উমর (রা)-কে ডেকে তাকে তা পাঠ করে শুনালে তিনি বলেন, হে আল্লাহ! আপনি মদ সম্পর্কে আমাদেরকে আরো স্পষ্ট করে বলে দিন। অত:পর সূরা নিসায় একটি আয়াত নাযিল হয়। যার অর্থ হলঃ “হে ঈমানদারেরা! তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সালাতের ধারে কাছেও যাবে না।”

তাই সালাতের আযানের পর সকলে সালাতের জন্য আসলে রাসূল (স) সকলকে জানিয়ে দেন ঃ তোমরা নেশাগ্রস্ত হয়ে কেউ সালাতে আসবে না।

অত:পর উমর (রা)-কে ডেকে রাসূল (স) এই আয়াতটি পাঠ করে শুনান। তখন উপর (রা) আবারো বলেন, হে আল্লাহ! আমাদেরকে এই সম্পর্কে সাফ সাফ করে বলে দিন।

অত:পর সূরা মায়িদার আলোচ্য ৯০ নং আয়াতটি নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ (স) তাঁকে ডেকে তা পাঠ করে শুনান। রাসূলুল্লাহ (স) যখন তা পড়ে فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ (তবু কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না) এই পর্যন্ত পৌছেন, তখন উমর (রা) বলে ওঠেন; আমরা নিবৃত্ত হলাম, আমরা তা বর্জন করলাম।

মদের সংজ্ঞা:

হাদীস-২: সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, একদা উমর ইব্ন খাত্তাব (রা) রাসূলুল্লাহ (স)-এর মিম্বারে উঠে ভাষণ দেন এবং বলেন: হে লোক সকল! মদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আংগুর, খেজুর, মধু, গম ও যব- এই পাঁচ বস্তু দ্বারা মদ তৈরি হয়। মদ উহাকে বলে যা পান করলে মানুষের জ্ঞান লোপ পায়।

হাদীস-৩: ইমাম আহমদ (র)... কা’কা’ ইব্ন হাকীম হতে বর্ণনা করেন যে, এক প্রশ্নের জবাবে ইব্ন আব্বাস (রা) বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (স)-কে এর বনী সাকীফ অথবা বনী দাওস গোত্রের এক বন্ধু মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল (স)-কে এক বোতল মদ উপঢৌকন স্বরূপ দেন। তখন রাসূল (স) তাকে বলেন ঃ ওহে! তুমি কি জান না যে, আল্লাহ মদ হারাম করেছেন? এ কথা শুনে লোকটি তার গোলামকে বলল, যাও এই মদ বিক্রি করে দাও। রাসূল (স) তাকে বললেন, ওহে! তুমি তাকে কি বললে? বলল, এই মদ বিক্রি করে দিতে বলেছি। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন ঃ যিনি মদ্যপান করা হারাম করেছেন, তিনি এটির ক্রয়-বিক্রয়ও হারাম করে দিয়েছেন। অতঃপর লোকটি তার গোলামকে মদের বোতলটি শহরের বাইরে নিয়ে ভেঙ্গে ফেলার জন্য আদেশ করে। 

সাবিত ও হাম্মাদ ইব্ন যায়দ আনাস (রা) হতে বর্ণনা করেন যে, আনাস (রা) বলেনঃ যে দিন মদ হারাম করা হয় সেদিন আমরা বেশ কয়েকজনে মিলে আবূ তালহার ঘরে বসে মদপান করছিলাম। মদগুলি ছিল খেজুর ও যব দিয়ে তৈরি খুবই উন্নত ধরনের। এমন সময় বাইরে কোন এক আহবানকারী লোকদেরকে সম্বোধন করে উচ্চস্বরে কি যেন বলছিলেন। আনাস (রা) বলেন, আমি আহবানের উচ্চ আওয়াজ শুনে বের হলাম। তখন শুনলাম যে, আহবানকারী বলছে, খবরদার! মদ হারাম করা হয়েছে। লক্ষ করলাম যে, মদীনার অলিগলি দিয়ে প্রসবণ ধারার মত মদ প্রবাহিত হচ্ছে। তখন আবূ তালহা আমাকে বলেন, তুমি বের হও, আমি আমার মদের পাত্রগুলি ভেংগে ফেলব। এই বলে তিনিও তাঁর মদের মটকিগুলি ভেংগে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেন। তখন কেহ এই কথা বলছিলেন যে, অমুক তো মদ হারাম হওয়ার পূর্বে পেটে মদ নিয়েই নিহত হয়েছে (তাদের অবস্থা কি হবে)? তাদের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা নিম্নের আয়াতটি নাযিল করেনঃ

لَيْسَ عَلَى الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ جُنَاحٌ فِيمَا طَعِمُوا إِذَا مَا اتَّقَوْا وَآمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ ثُمَّ اتَّقَوْا وَآمَنُوا ثُمَّ اتَّقَوْا وَأَحْسَنُوا وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ

অর্থাৎ, ‘যারা বিশ্বাস করে ও সৎকার্য করে, তারা পূর্বে যা ভক্ষণ করেছে তজ্জন্য তাদের কোন পাপ নেই।’

হাদীস-৪:

ইমাম আহমদ (র)... ইব্ন উমর (রা) হতে বর্ণনা করেন যে, ইব্ন উমর (রা) বলেন, রাসূল (স) বলেছেনঃ মদের সাথে জড়িত দশ ব্যক্তির উপর আল্লাহর অভিশাপ। যথাঃ (১) মূল মদ (২) মদ্যপায়ী (৩) মদ পরিবেশক (৪) বিক্রেতা (৫) ক্রেতা (৬) মদ উৎপাদনকারী কর্মচারী, (৭) মদ উৎপাদক, (৮) পরিবাহক (৯) মদ আমদানীকারক ও উহার (১০) বিক্রয়লব্দ অর্থ ভক্ষণকারী- এই সকল ব্যক্তির উপর আল্লাহর অভিশাপ।

হাদীস-৫:

আব্দুল্লাহ ইব্ন ওয়াহব (র).... আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইব্ন আস (রা) হতে বর্ণনা করেন যে, আব্দুল্লাহ ইব্ন আমর ইব্ন আস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেনঃ তাদের যদি নেশাগ্রস্ত হওয়ার কারণে এক ওয়াক্ত সালাত তরক হয়ে যায়, তাহলে সে যেন তার নিকট কুক্ষিগত পৃথিবীর সকল সম্পদ হারিয়ে ফেলল। আর কেউ যদি নেশাগ্রস্ত হয়ে একাধারে চার ওয়াক্ত সালাত তরক করে, তাহলে তার উপযুক্ত খাদ্য হল ‘তীনাতুল খিবাল’। প্রশ্ন করা হল, ‘তীনাতুল খাবাল’ কি? তিনি বললেনঃ জাহান্নামীদের শরীর হতে বিগলিত রক্ত ও পুঁজ। 

হাদীস-৬:

ইমাম আবূ দাঊদ (র) (তাঁর কিতাবে) ইব্ন আব্বাস (রা) হতে বর্ণনা করেন যে, ইব্ন আব্বাস (রা) বলেন, রাসূল (স) বলেছেন ঃ প্রত্যেক মদই নেশাদার এবং প্রত্যেক নেশাদার বস্তুই (গুল, জর্দা, বিড়ি-সিগারটও) হারাম । তাই যে ব্যক্তি নেশার দ্রব্য পান করবে, তার ৪০ দিনের সালাত বরবাদ হয়ে যাবে। তবে সে তাওবা করলে  আল্লাহ তার তাওবা কবুল করবেন। এভাবে সে ৪র্থবার নেশা করলে তাকে ‘তীনাতুল খিবাল’ খাওয়ানোর অধিকার আল্লাহর আছে। তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল, ‘তীনাতুল খাবাল’ কি? তিনি বললেনঃ জাহান্নামীদের শরীর হতে বিগলিত রক্ত ও পুঁজ।  তেমনি যে ব্যক্তি হালাল-হারাম সম্পর্কে অপরিজ্ঞত কোন শিশুকে নেশা পান করাবে, তাকেও ‘তীনাতুল খিবাল’ খাওয়ানোর অধিকার আল্লাহর রয়েছে। 

হাদীস-৭:

আব্দুল্লাহ ইব্ন উমর (রা) বলেন, রাসূল (স) বলেছেনঃ আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির প্রতি তাকবেন নাঃ

এক. পিতামাতার অবাধ্য সন্তান

দুই. নেশাখর

তিন. সেই ব্যক্তি যে উপকার করে খোঁটা দেয়।

(মুসনাদের আহমাদের হাদীসে বলা হয়েছে এই ৩ ব্যক্তি জান্নাতেই প্রবেশ করতে পারবে না।)

হাদীস-৮:

সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (স) বলেছেনঃ যেনাকারী যখন যেনা করে তখন সে মুমিন থাকতে পারে না, চোর যখন চুরি করে তখন সে মুমিন থাকতে পারে না এবং নেশাড়ুু যখন নেশা করে তখন সে মুমিন থাকতে পারে না।

হাদীস-৯:

আবূ বকর ইব্ন আব্দুর রহমান ইব্ন হারিস ইব্ন হিশাম বলেনঃ তাঁর পিতা বলেছেন, তিনি উসমান ইব্ন আফফান (রা) কে বলতে শুনেছেন যে, তোমরা মদ পরিত্যগ কর। কেননা তা সকল অন্যায় ও অপবিত্রতার উৎস। অতঃপর তিনি এই ঘটনাটি বলেনঃ

তোমাদের পূর্ব যুগে এমন একজন আল্লাহওয়ালা আবিদ ব্যক্তি ছিলেন যিনি ঘরবাড়ি ও লোকালয় ত্যাগ করে নির্জনে ইবাদত করতেন। একদিন তাঁর প্রতি এক দুষ্ট মহিলার দৃষ্টি পড়ে। তারপর মহিলা তার পরিচারিকার মাধ্যমে আবিদকে এই বলে যেকে পাঠায় যে, তাকে কোন বিষয়ে সাক্ষী রাখা হবে। আবিদ পরিচারিকার সাথে মহিলার বাড়ি গেলেন। তিনি যখন তার ঘরে প্রবেশ করছিলেন তখন যে দরজাটি অতিক্রম করছিলেন, সিটিই পিছন হতে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল। এভাবে কয়েকটি দরজা অতিক্রম করার পর মহিলার সঙ্গে সাক্ষাত হয়। সেই মহিলার পাশে রাখা হয়েছিল এক হাঁড়ি মদ এবং একটি শিশু। মহিলা তাকে বলল, আল্লাহর কসম! আমি আপনাকে কোন সাক্ষের জন্য ডাকি নি; বরং আপনাকে আমার এইখানে ডাকার উদ্দেশ্য হল, হয় আপনি আমার সঙ্গে যেনা করবেন অথবা এই শিশুটিকে হত্যা করবেন অথবা মদ্যপান করবেন।

আবিদ ব্যক্তি ভাবলেন, এসবের মধ্যে সবচেয়ে সহজ গুনাহ হল মদ্যপান। তাই তিনি পাত্রে পদ নিয়া পান করতে লাগলেন। প্রথমবার পান করার পর নেশাগ্রস্ত হল তিনি নেশা চরম পর্যায়ে পৌঁছে, তখন প্রথমে সে সেই মহিলার সাথে যেনায় লিপ্ত হয় এবং পরে সেই শিশুটিকেও হত্যা করে।

তাই তোমরা মদ হতে আত্মরক্ষা কর। কেননা মদ এবং ঈমান একটিত্রত হতে পারে না। কেউ যখন মদ্যপান করে, তখন ঈমান থাকতে পারে না এবং যখন ঈমান থাকে, তখন সে মদ্যপান করতে পারে না।

জুয়া সম্পর্কে একটি হাদীসঃ 

আব্দু্ল্লাহ ইব্ন মাসউদ (রা) বলেন, রাসূল (স) বলেছেনঃ তোমরা জুয়া চাওসার (এক প্রকার খেলা) ও দাবা খেলা পরিত্যাগ কর। কেননা ইহা অনারবরা জুয়া হিসাবে খেলে।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url