ইলম, শিক্ষা ও স্বাক্ষরতা
ইসলামে স্বাক্ষরতা, শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের সর্ব্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এবং একে সকল মুমিন নরনারীর জন্য ব্যক্তিগতভাবে ফরয করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ বলেছেন,
طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيْضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمْ.
অর্থ-ইলম সন্ধান করা প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয। (ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৮১; হাদীসটি
সহীহ্)
ইলম অর্জনকারী তথা আলিমদের প্রশংসায় আল্লাহ্ বলেন:
اَلَمْ تَرَ أَنَّ اللهَ أنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجْنَا بِهِ ثَمَرَاتٍ مُخْتَلِفً أَلْوَانُهَا وَمِنَ الْجِبَالِ جُدَدٌ بِيضٌ وَحُمْرٌ مُخْتَلِفٌ أَلْوَانُهَا وَغَرَابِيْبُ سُودٌ. وَمِنَ النَّاسِ والدَّوَابٌ وَالْأَنْعَامِ مُخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ كَذَلِكَ إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ إِنَّ اللهَ عَزِيْزٌ غَفُوْرٌ.
অর্থ-তুমি কি দেখ না আল্লাহ্ আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং আমি তা দ্বারা
বিচিত্র বর্ণের ফলমূল উদ্গত করি? পাহাড়ের মধ্যে আছে বিচিত্র বর্ণের পথ-শুভ্র, লাল ও নিকষ কাল। এভারে রং বেরং-এর মানুষ, জন্তু ও গৃহপালিত প্রাণী। আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারাই আল্লাহকে ভয় করে। (সূরা ফাতির, আয়াত ২৭,২৮)
এ আয়াতে আলিমদের প্রশংসা করা হয়েছে যে, তাঁরাই আল্লাহকে ভয় করেন। এছাড়া আমরা দেখতে পাই যে, এখানে সৃষ্টির বৈচিত্র ও সৃষ্টিতত্ত্বের সাথে জ্ঞানকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এ থেকে জানা
যায় যে, প্রকৃতি বিজ্ঞাস-সহ জ্ঞানের সকল শাখাই ইসলামের দৃষ্টিতে প্রশংসনীয় জ্ঞান বা ইসলামী জ্ঞান। কুরআনের এরূপ আয়াত ও বিভিন্ন হাদীসের আলোকে আলিমগণ উল্লেখ করেছেন যে, মানুষের কল্যাণকর সকল শিক্ষাই ইসলামী শিক্ষা।
ভাষা, সাহিত্য, চিকিৎসা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, গণিত, ভূগোল ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের
অন্যান্য শাখাই জ্ঞানার্জন ও শিক্ষালাভ ইসলামের নির্দেশ। সকল বিষয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষজ্ঞ তৈরি করা মুসলিম সমাজের জন্য ফরজে কিফাইয়া দায়িত্ব। মুমিনদের জন্য ফরজে আইন বা ব্যক্তিগত ফরজ ইবাদত হলো নিজের ঈমান ও ইসলামকে সংরক্ষণ করার ও প্রয়োজনীয় সকল ইবাদত ও লেনদেন ইসলাম-সম্মতভাবে আদায় করার জন্য আবশ্যকীয় “শরয়ী” জ্ঞান অর্জন করা। এরপর মুমিন তার নিজের ও সমাজের চাহিদা অনুসারে জ্ঞানের যে কোন শাখায় পারদর্শিতা অর্জন করবেন।
রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) স্বাক্ষরতা ও শিক্ষার অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। বদরের যুদ্ধে কিছু কাফির যোদ্ধা বন্দী হন, যারা লেখাপড়া
জানতেন। স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ্ (ছাঃ) নির্দিষ্ট সংখ্যক
মুসলিম শিশু-কিশোরের লেখাপড়া শেখানোর বিনিময়ে তাদেরকে মুক্তি প্রদানের ব্যবস্থা
করেন। (ইমাম আহমদ, আল-মুসনাদ ৪/৪৭, সনদ ছহীহ্)
স্বাক্ষরতা বা সাধারণ শিক্ষাও প্রয়োজন। ইসলাম এটিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিয়েছে। তবে দ্বীনী শিক্ষা তথা ইলম অর্জন করাকে দিয়েছে
আরো বেশি গুরুত্ব এবং এর ফযিলতও অনেক বেশি। এ মর্মে মহান আল্লাহ্ ইরশাদ করেন,
فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَآ إِلَهَ إِلَّا اللهُ.
অর্থ- অতএব তুমি জান (জ্ঞান অর্জন কর) যে আল্লাহ্ ছাড়া কোনো মাবূদ নেই। (সূরা মুহাম্মদ, আয়াত-১৯)
এ মর্মে মহান আল্লাহ্ আরো ইরশাদ করেন,
يَرْفَعِ اللهُ الَّذِيْنَ آمَنُوْا مِنْكُمْ وَالَّذِيْنَ أُوْتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ، وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْرٌ.
অর্থ-তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে ইলম বা জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে
তাদের মর্যদা আল্লাহ্ বাড়িয়ে দিবেন। তোমরা কি কর্ম কর তা আল্লাহ্ সম্যক অবগত আছেন।
(সূরা মুজাদালা, আয়াত-১১)
এ মর্মে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّيْنِ.
অর্থ-আল্লাহ্ যার মঙ্গলের ইচ্ছা করেন তাকেই দীনের সঠিক জ্ঞান ও বুঝ প্রদান করেন। (ছহীহ্ বুখারী, ১/ ৩৭; মুসলিম ২/৭১৮-৭১৯)
এ মর্মে রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন,
فَضْلُ الْعِلْمِ خَيْرٌ مِنْ فَضْلِ الْعِبَادَةِ.
অর্থ-ইবাদতের ফযীলতের চেয়ে ইলমের ফযীলত অধিক উত্তম। (হাকিম, আল মুসতাদরাক, ১/১৭১, হাদীসটি সহীহ)
হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে এ মর্মে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। নিম্নে এ সংক্রান্ত আরো একটি উল্লেখ করা হলোঃ
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, “যদি কেউ ইলম শিক্ষার মানসে কোনো পথে চলে, তবে আল্লাহ্ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। ফিরিশতাগণ ইলম শিক্ষার্থী তথা ত্বালিবে ইল্ম্-এর এই কর্মের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তার জন্য তাদের পাখনাগুলি বিছিয়ে দেন। আলিমের জন্য আসমান এবং জমিনের সকলেই ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি পানির মধ্যে থাকা মাছও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। তারকারাজির উপরে চাঁদের যেমন মর্যাদা, ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত ‘আবিদের’ উপরে ‘আলিমের’ মর্যাদা তেমনই। আলিমরাই হচ্ছেন নবীদের উত্তরাধিকারী। নবীরা (আঃ) কোনো টাকা পয়সা দীনার-দিরহাম উত্তরাধিকার রেখে যান নি। তাঁরা শুধু ইলম-এর উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। কাজেই যে ব্যক্তি ইলম গ্রহণ করল, সে নবীদের উত্তরাধিকার থেকে একটি বড় অংশ গ্রহণ করল।” (সহীহ্ বুখারী ১/৩৭, সনদ হাসান)
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, “যদি কোন ব্যক্তি সকাল সকাল বা দ্বিপ্রহরের পূর্বে মসজিদে গমন করে, তার গমনের একমাত্র উদ্দেশ্য হয় (ইমামের খুতবা থেকে) কোনো ভাল কিছু শিক্ষা করা অথবা শিক্ষা দেওয়া, তবে সেই ব্যক্তি একটি পরিপূর্ণ হজ্জের সাওয়াব লাভ করবে।” (মুনযিরী, আত-তারগীব ১/৫৯) অন্য হাদীসে তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি আমার মসজিদে আগমন করবে, তার একমাত্র উদ্দেশ্য হবে কোনো ভাল বিষয় শিক্ষা করা বা শিক্ষা দেওয়া, সেই ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীগণের মর্যাদা লাভ করবেন।” (ইবনু মাজাহ্, আস-সুনান ১/৮২)
অন্য হাদীসে রাসূল (ছাঃ) সাহাবী আবূ যার (রাঃ) কে বলেন,“তুমি যদি কুরআনের একটি আয়াত শিক্ষা কর, তবে তা তোমার জন্য ১০০ রাক‘আত নফল সালাত আদায় করার থেকেও উত্তম। আর যদি তুমি ইলমের একটি অধ্যায় শিক্ষা কর-আমল কৃত অথবা আমলকৃত নয়- তবে তা তোমার জন্য ১০০০ রাক‘আত সালাত আদায় করা থেকেও উত্তম।” (ইবনু মাজাহ্, আস-সুনান ১/৭৯, সনদ হাসান)
অন্যকে ইলম শিক্ষা দেওয়া অনেক ফযিলতের একটি কাজ। এ মর্মে রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন, “যদি কেউ কোন ইলম শিক্ষা দেয়, তবে সেই শিক্ষা অনুসারে যত মানুষ কর্ম করবে সকলের সমপরিমাণ সাওয়াব ঐ ব্যক্তি লাভ করবে, কিন্তু এতে তাদের সাওয়াবের কোনো ঘাটতি হবে না।” (ইবনু মাজাহ্, আস-সুনান ১/৮৮, সনদ হাসান)
আলিমগণের মর্যাদা প্রসঙ্গে রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন,“যে ব্যক্তি বড়দের সম্মান করে না, ছোটদের স্নেহ করে না এবং আলেমদের (জ্ঞানীদের) মর্যাদা-অধিকার বোঝে না সে আমার উম্মতের উন্তর্ভূক্ত নয়।” (আহমদ, আল-মুসনাদ ৫/৩২৩, সনদ হাসান)
এ মর্মে রাসূল (ছাঃ) আরো বলেন,
إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ إِنْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ ثَلَاثَةٍ، إِلَّا مِنْ صَدْقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُوْ لَهُ.
অর্থ- যখন কোন আদম-সন্তান মৃত্যুবরণ করে তখন তার সকল কর্ম বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তিনটি কর্মের সওয়াব সে অব্যাহতভাবে পেতে থাকে। (আর তা হলো) ১. সাদকায়ে দারিয়াহ্ (প্রবাহমান দান) ২. উপকারী ইলম ৩. নেক সন্তান যে সন্তান তার জন্য দোয়া করতে থাকে। (মুসলিম, আস-সহীহ্ ৩/১২৫৫)
Visit Our English Site : Click Here
Thanks for reading. جزاك الله خيرا